
উদীচী চট্টগ্রামের সভাপতি শহীদজায়া ও সাহিত্যিক বেগম মুশতারী শফী'দি আর নেই খবরটা শুনে কয়েক মিনিটের জন্য নিঃশ্চুপ হয়ে বসে রইলাম। (ইন্না লিল্লাহী ওয়া ইন্না এলাহী রাজিউন)। দি'কে নিয়ে আজ অনেক স্মৃতি মনের আকাশে ভেসে উঠছে। সময়টা তখন পেট্রোলবোমার! হ্যাঁ, মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য চলছিলো! কাদের মোল্লার ফাঁসির রায়ের পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদন্ডের প্রতিবাদে রাজপথে নেমেছিলো বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী সহ দেশপ্রেমিক, শুভ ও শ্রেয়বোধের প্রতিবাদী কোটি জনতা। শাহবাগ থেকে শুরু করে সারাদেশ ব্যাপী গণজাগরণে কেঁপে উঠে রাষ্ট্র! নড়ে-চড়ে বসেন রাষ্ট্রের বড় বড় সব হর্তা-কর্তা! বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক আন্দোলনে চির-যৌবনা, এক, অভিন্ন এবং প্রতিবাদী গণমানুষের অধিকার আদায়ে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ সাংস্কৃতিক সংগঠন। সাংস্কৃতিক আন্দোলন এবং গণজাগরণের ফলে আওয়ামী সরকার বাধ্য হয়ে আইন সংশোধন করে রাজাকার কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করে। সে সময় জামায়াত- শিবির, বিএনপির সমস্ত গুন্ডাবাহিনী, সন্ত্রাসবাহিনী এবং পাকিস্তানের আইএসআই-এর নেতৃত্বে সারাদেশব্যাপী ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়! ঠিক যেন ১৯৭১ সালের মতো অগ্নি-সংযোগ, রেল লাইন উপড়ে ফেলা, বাসে-ট্রেনে পেট্রোল বোমা মেরে নিরীহ-সাধারণ মানুষদের পুড়ে ফেলা, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়ার মতো মানবতাবিরোধী নৃশংসতায়, উন্মাদনায় মেতে উঠে। আইন-শৃঙ্খলা-বাহিনীর সদস্যদের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করার মতো স্পর্শকাতর ঘটনাও ঘটিয়েছে এই জামায়াত-বিএনপি নামক পাকিস্তানের পেইড এজেন্ট দলগুলো। বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামীলীগও তখন ভীষণ চিন্তিত। বৈশ্বিক চাপ, জামায়াত-বিএনপির চোরাগুপ্তা হামলা, বোমা বিস্ফোরণ, অগ্নি-সংযোগ, মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা, পুলিশকে পিটিয়ে হত্যার মতো ঘটনায় সারাদেশবাসী যখন আতঙ্কিত! ঠিক সেই সময় জামায়াত-বিএনপির বোমা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে, সকল রাজাকারের ফাঁসির দাবিতে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী রাজপথে নামে। সেই রাজপথের লড়াকু যোদ্ধা শহীদ জায়া মুশতারী শফী'দি! শহীদজায়া মুশতারী শফি'দি-কে নিয়ে নতুন করে লেখার মতো কলমের কালি এ ক্ষুদ্র, নগণ্যের কাছে নেই! আমি তখন উদীচী টঙ্গী শাখার কোষাধক্ষ্য। খবর আসলো চিটাগং হটস্পট। সময়টা তখন ২০১৪ সালের শেষের দিক! ছুটে গেলাম চট্টগ্রামে। নিউ মার্কেট এলাকায় ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন ও উদীচীর কার্যালয়। জামাল খানে প্রেসক্লাব! .
চেরাগী পাহাড়ের মোড়ে পেট্রোল বোমার বিরুদ্ধে ও রাজাকারদের ফাঁসির দাবিতে যে মিছিল হয় সেই মিছিলেই শহীদজায়া মুশতারী শফী'দির সাথে আমার প্রথম পরিচয়। এই বয়সে এসে এরকম প্রতিবাদী-জ্বালাময়ী, দুঃসাহসিক এবং স্পষ্ট দাবী বক্তব্যের মধ্যে জানাতে পারে তা মুশতারী শফি'দি-কে কাছে থেকে না দেখলে জানা যেত না। ছাত্র ইউনিয়ন নেতা ছোট ভাই আমির খবর নিয়ে এলো- চেরাগী পাহাড়ের সেই উদীচীর আন্দোলনের লাইভ সম্প্রচার বন্ধ করা না হলে জামায়াত-শিবির জামাল খানের প্রেসক্লাবটি বোমা মেরে উড়িয়ে দিবে। চট্টগ্রামের কয়েকজন সাংবাদিকের সাথে কথা বলার চেষ্টা করলাম। তখন বুঝতে পারলাম- সেই সময় চট্টগ্রামের সাংবাদিক সহযোদ্ধারা কতোটা ঝুঁকি নিয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালন করে গেছেন। কারণ, জামালখান রোডের প্রেসক্লাব থেকে মোড়ে পাহাড়ের উপর চার্চ আর পাহাড়ের বুক চিড়ে মহসিন কলেজ, চট্টগ্রাম কলেজ হয়ে চকবাজার পর্যন্ত জামায়াত-শিবিরের অভয়ারণ্য। যেখানে ছাত্রলীগ নেতার দেহ থেকে মস্তক আলাদা করে ক্যাম্পাস, চকবাজার চক্কর দেয় শিবিরের ক্যাডাররা সেখানে অকুতোভয় মুশতারী'দির মিছিল দেখেছি, শ্লোগান শুনেছি। রূগ্ন শরীরে ঘাতকদের বুলেট বোমা উপেক্ষা করে রাজপথে দেখেছি এই সাংস্কৃতিক যোদ্ধাকে। সে সময় আওয়ামীলীগ নেতা এবিএম মহিউদ্দীন চৌধুরী উদীচীর সেই সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সংহতি জানান। এছাড়াও শহীদ মিনার ও ডিসি হিল এলাকায় মুশতারী'দির আরও দুটি বক্তব্য থেকে অনেক কিছুই শিক্ষা নিয়েছিলাম। .
দামপাড়া শিল্পকলা একাডেমিতে "ক্ষুদিরামের ফাঁসি"- নাটকটি মঞ্চস্থের পূর্বে আমাকে বলেছিলো- ধ্রুব, এদেশে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পথটা খুব সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে, সংকুচিত হয়ে আসছে। সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছাড়া স্বাধীনতার স্বাধ পূর্ণ হবে না, মুক্তি মিলবে না। হোক সেটা বর্তমান ক্ষমতাসীনরা কিংবা অতীতের জামায়াত-বিএনপি! তারা কেউ-ই চায়না সাধারণ একজন মানুষ তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন হোক! তারা চায় না- সাংস্কতিক আন্দোলনে কেউ আসুক! কয়লা ধুইলে যেমন ময়লা যায় না ঠিক তেমনই এদেশের আলো-বাতাস, অক্সিজেন নিয়ে বেঁচে থাকা ওই কাল সাপদের পাকিস্তানপ্রীতি কোন দিনও যাবে না! ওরা আজও মনেপ্রাণে পাকিস্তানকে ভালোবাসে। তোমরা যারা জার্নালিস্ট আছো তোমাদের উচিৎ এই মুখোশ উন্মোচ্চনে আরও যত্নবান হওয়া এবং সে অনুযায়ী পাবলিসড করা। ভবিষ্যৎ প্রজন্মদের জন্য আরও অনেক কাজ করা বাকি আছে আমাদের। এ দায় আমরা কোন ভাবেই এড়িয়ে যেতে পারি না। আমরা যদি তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তথ্য জানাতে না পারি তাহলে জাতী আমাদের কোন দিনও ক্ষমা করবে না। সেদিন, তিনি পুরানো "বান্ধবী" ম্যাগাজিনের একটা সংখ্যা দিয়ে বলেছিলেন- আমাদের দেশের নারীরা প্রতিটি ক্ষেত্রে চরম অবহেলিত। অসহায় নারীদের উন্নয়ন নিয়ে তিনি বেশ কিছু উদ্যোগের কথা বলেছিলেন। দুঃসাহসিক এই পরিচ্ছন্ন চেতনার দেশপ্রেমিক, স্বাধীন বাঙলা বেতার কেন্দ্রের শব্দ সৈনিক, নারী উদ্যোক্তা ও সাংস্কৃতিক যোদ্ধার চলে যাওয়ার খবরটা শুনে মনের আকাশটা ভারী হয়ে আসছে। খসে পড়লো এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। জানি, উজ্জ্বল নক্ষত্রেরা জ্যোতি ছড়ায় অহর্নিশি। তবুও- মনটা কাঁদে! .
দ্রোহে-প্রেমে-প্রতিবাদে,
উৎসবে-সংকটে-দূর্যোগে,
বেতারে-ইথারে-অনলাইনে,
মঞ্চে- ময়দানে - রাজপথের শ্লোগানে
বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী চট্টগ্রাম সংসদের সভাপতি, বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও শহীদজায়া বেগম মুশতারী শফি একজন নিবেদিত প্রাণ! যে প্রাণের কখনো মৃত্যু নেই, যে প্রাণের কখনো ক্ষয় নেই, ভয় নেই! এমন প্রাণ জন্ম নিক বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে, এমন নক্ষত্র আলো ছড়াক বাংলার আকাশ জুড়ে!!!.
এক নজরে শহীদজায়া মুশতারী'দি-.
একাত্তরের রণাঙ্গনে বিশেষ অবদান রাখা নারীনেত্রী ও শহীদজায়া বেগম মুশতারী শফী আর নেই (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। সোমবার (২০ ডিসেম্বর) বিকেলে রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। বেগম মুশতারী শফীর জামাতা আবদুল্লাহ জাফর তার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন।
মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। তিনি সাত ছেলে-মেয়ে রেখে গেছেন। একাত্তরে মুশতারী শফীর স্বামী ডা. মোহাম্মদ শফীকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়েছিল।
৮৪ বছর বয়সী মুশতারী শফী কিডনি, রক্তে সংক্রমণসহ নানা জটিলতায় ভুগছিলেন। গত ২ ডিসেম্বর উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম থেকে তাকে ঢাকায় আনা হয়েছিল।
মুশতারী শফীর ছেলে মেহরাজ তাহসীন শফী জানান, তার মরদেহ মঙ্গলবার (২১ ডিসেম্বর) চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়া হবে এবং সেখানেই দাফন করা হবে।
১৯৩৮ সালের ১৫ জানুয়ারি তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে মুশতারী শফীর জন্ম। তার বাবার বাড়ি ফরিদপুরে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ৭ এপ্রিল তার স্বামী চিকিৎসক মোহাম্মদ শফী ও ছোট ভাই এহসানুল হক আনসারীকে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের দিন পর্যন্ত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে শব্দসৈনিক হিসেবে কাজ করেছেন বেগম মুশতারী।
নারী অধিকার আদায়ে দীর্ঘ সংগ্রাম করেছেন মুশতারী শফী। ১৯৬৩ সালে চট্টগ্রাম থেকে ‘বান্ধবী’ নামে মাসিক সাময়িকী প্রকাশ করেছিলেন। এটি ছিল বাংলাদেশের নারীদের জন্য দ্বিতীয় সাময়িকী।একাত্তর পরবর্তী সময়ে তিনি ছিলেন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির অন্যতম সংগঠক। মুশতারী শফী ‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের নারী’, ‘চিঠি’, ‘জাহানারা ইমামকে’ এবং ‘স্বাধীনতা আমার রক্তঝরা দিন’ প্রভৃতি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গ্রন্থ রচনা করেছেন।.
মুক্তিযুদ্ধে অনন্য অবদান রাখায় ২০১৬ সালে শহীদজায়া মুশতারী শফীকে ফেলোশিপ দেয় বাংলা একাডেমি। ২০২০ সালে পান বেগম রোকেয়া পদক এই মহীয়সী নারী।.
জয়তু মুশতারী'দি
জয় উদীচী।.
শাহীনুর ইসলাম নয়ন
(সাংবাদিক, উদীচী নাট্যকর্মী)
২০ ডিসেম্বর ২০২১ ইং
ক্যান্টনমেন্ট, ঢাকা।.
Ajker Bogura / সোশ্যাল মিডিয়া সংবাদ
আপনার মতামত লিখুন: